আপনার শিশুর জন্ম হওয়ার পরপরেই ৪৫ দিনের মধ্যে শিশুর জন্ম নিবন্ধন করে ফেলার জন্য বাংলাদেশ সরকার নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে। তবে ৪৫ দিনের মধ্যে করতে না পারলে যে জন্ম নিবন্ধন করা যাবে না এমনটা নয়।
সিস্টেমের কারণে অনেকেই জন্ম নিবন্ধন করাটাকে অনেক ঝামেলার কাজ মনে করে। যার জন্য জন্ম নিবন্ধন করার ক্ষেত্রে দেখা যায় আগ্রহীনতা।
তবে আশার বাণী এই যে, বর্তমান সময়ে জন্ম নিবন্ধন করা খুব সহজ হয়ে গিয়েছে। অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন আবেদন করা থেকে শুরু করে জন্ম নিবন্ধন হাতে পাওয়া পর্যন্ত সকল কাজ আপনি নিজেই কারো সাহায্য ছাড়াই করতে পারবেন।
এর জন্য আপনাকে শুধু জানতে হবে “কিভাবে জন্ম নিবন্ধন করা যায়?” এই আর্টিকেলটিতে আমি আপনাকে ধাপে ধাপে শিখিয়ে দেবো অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন আবেদন করার নিয়ম। চলুন জেনে নেওয়া যাক!
নতুন জন্ম নিবন্ধন আবেদন
বাংলাদেশের সংবিধানে ২০০৪ সালের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, একটি নবজাতক শিশু জন্ম নেওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যেই জন্ম নিবন্ধন করাতে হবে, এটাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
তবে অনেকের ক্ষেত্রে ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর মধ্যে জন্ম নিবন্ধন করে ফেলার নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে।
যদি কেউ এই উভয় নিয়ম ভঙ্গ করে পাঁচ বছরের ঊর্ধ্বে অন্য যেকোনো বয়সে জন্ম নিবন্ধন করতে চায়, তবে তাকে অতিরিক্ত ডকুমেন্টস দিয়ে কিছুটা ঝামেলার মাধ্যমেই জন্ম নিবন্ধন করাতে হবে।
একটা সময় জন্ম নিবন্ধন তৈরিতে হাতের লেখা হতো, যেটাকে বর্তমানে এনালক জন্ম সনদ বলা হয়। বর্তমানে নতুন জন্ম নিবন্ধন আবেদন করলে ডিজিটাল জন্ম সনদ দেয়া হয়।
আরও পড়ুনঃ কীভাবে অনলাইনে জন্ম সনদ চেক করা যায়।
জন্ম নিবন্ধন করতে কি কি লাগে?
যেমনটা বলা হলো জন্ম নিবন্ধন জীবদ্দশায় তিনটি সময় করা যায়। আর তিনটি সময়েই ডকুমেন্টস সাবমিশনে যে ভিন্নতা সেটা তুলে ধরবো।
বয়স ০ – ৪৫ দিন হলে জন্ম নিবন্ধন করতে যা যা লাগবে
- টিকাকার্ড অথবা হাসপাতালের ছাড়পত্র
- হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের রশিদ
- পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি অথবা জন্ম নিবন্ধন কপি
- অভিভাবকের মোবাইল নাম্বার
বয়স ৪৫ দিন – ৫ বছর হলে জন্ম নিবন্ধন করতে যা যা লাগবে
- স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মীর সত্যায়িত প্রত্যয়ন পত্র
- পিতা মাতার NID/Birth Certificate কপি
- ট্যাক্স পরিশোধের রশিদ
- স্কুলে ভর্তি থাকলে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রত্যয়ন পত্র
- অভিভাবকের মোবাইল নাম্বার
বয়স ৫ বছরের বেশি হলে জন্ম নিবন্ধন করতে যা যা লাগবে
- বয়সের সঠিক নির্ণয়ের জন্য সরকারি এমবিবিএস ডাক্তার কর্তৃক সত্যায়িত প্রত্যয়ন পত্র
- PSC/JSC/SSC/HSC এর সার্টিফিকেট
- পিতা-মাতার NID/Birth Certificate এর কপি
- জন্মস্থান এবং স্থায়ী ঠিকানার প্রমাণ সরূপ হোল্ডিং ট্যাক্স প্রদানের কপি
জন্ম নিবন্ধন করতে কত টাকা লাগে?
শিশু জন্ম গ্রহণের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন করানো হলে, জন্ম নিবন্ধনের চার্জ প্রযোজ্য নয়। তবে শিশুর বয়স ৪৫ দিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে থাকলে জন্ম নিবন্ধন ফি হিসেবে ২৫ টাকা প্রদান করতে হয়।
যদি পাঁচ বছরের অধিক কোন ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধন করানো হয় সে ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধন ফি ৫০ টাকা। এটি সরকার দ্বারা নির্ধারিত ফি, তবে অনেক স্থানের শোনা যায় যে জন্ম নিবন্ধন করানোর ক্ষেত্রে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা নিয়ে থাকে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে। এমতাবস্থায় নিকটবর্তী থানা কিংবা ৯৯৯ কল করে বিষয়টি অবগত করবেন।
অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন আবেদন করার নিয়ম
এবার ধাপে ধাপে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন আবেদন করার নিয়ম সম্পর্কে জানানো হবে। এক্ষেত্রে আপনাকে সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে আবেদন করতে হবে না। আবেদনের সকল কার্যক্রম অনলাইন এর মাধ্যমে করতে পারবেন। তবে “জন্ম সনদ” চলে আসলে সেটি ইউনিয়ন পরিষদ অথবা কাউন্সিল অফিসে গিয়ে নির্দিষ্ট ফি প্রদানের মাধ্যমে নিয়ে আসতে পারবেন।
পরামর্শঃ Birth Certificate Apply করার সময় সকল তথ্য সতর্কতার সাথে সঠিকভাবে প্রদান করবেন। কেননা আবেদনের সময় কোথাও ভুল হলে পরবর্তীতে জন্ম সনদ সংশোধন করার ঝামেলা বহন করতে হবে।
১ম ধাপ: ওয়েবসাইট ভিজিট ও তথ্য প্রদান
অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন আবেদন করার জন্য প্রথমেই সরাসরি জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের আবেদন পেজে যেতে হবে।
জন্ম নিবন্ধন আবেদন করতে নিচের বাটনে চাপ দিন:
আপনি কোন স্থান থেকে জন্ম নিবন্ধন করাতে চান (জন্মস্থান নাকি স্থায়ী ঠিকানা) সেটি সিলেক্ট করুন এবং পরবর্তী বাটনে ক্লিক করুন।
প্রথমেই নিবন্ধনাধীন ব্যক্তির পরিচয় তথা:
- বাংলা নামের প্রথম ও শেষ অংশ
- ইংরেজি নামের প্রথম ও শেষ অংশ
- জন্ম তারিখ
- পিতামাতার কততম সন্তান
- লিঙ্গ ইত্যাদি
প্রদান করে দেশ, বিভাগ ও জন্মস্থানের সম্পুর্ণ ঠিকানা বাংলা এবং ইংরেজিতে লিখে সাবমিট করতে হবে।
এই পর্যায়ে এসে পিতা ও মাতার পৃথক তথ্য প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে যেসকল তথ্য দিতে হবে তা হলো:
- পিতা ও মাতা উভয়ের জন্ম নিবন্ধন নাম্বার
- জন্ম তারিখ
- উভয়ের বাংলা এবং ইংরেজিতে নাম
- উভয়ের জাতীয় পরিচয় পত্রের নাম্বার
সবশেষে উভয়ের জাতীয়তা নির্বাচন করে পরবর্তী বাটনে ক্লিক করুন।
২য় ধাপ: ঠিকানা সংক্রান্ত তথ্য
এই ধাপে এসে নিবন্ধনাধীন ব্যক্তির বর্তমান ঠিকানা এবং স্থায়ী ঠিকানা সংক্রান্ত তথ্য প্রদান করতে হবে। যদি পূর্বে উল্লেখ্যিত জন্মস্থান ও স্থায়ী ঠিকানা একই হয় তবে “জন্মস্থানের ঠিকানা ও স্থায়ী ঠিকানা একই” চেকবক্সে ক্লিক করতে হবে।
আবার স্থায়ী ঠিকানা ও বর্তমান ঠিকানা দুইটিই একই স্থানের হয় তবে “স্থায়ী ঠিকানা ও বর্তমান ঠিকানা একই” নামক চেকবক্সে টিক দিয়ে দিতে হবে।
যদি জন্মস্থান, স্থায়ী ঠিকানা, বর্তমান ঠিকানা পৃথক হয় তবে ঠিকানা সেকশনে যে তথ্য গুলো দিতে হবে সেগুলো হলো:
- দেশ
- বিভাগ
- ডাকঘর (বাংলা ইংরেজি উভয় ভাষায়)
- গ্রাম / পাড়া / মহল্লা (বাংলা ইংরেজি উভয় ভাষায়)
- বাসা সড়কের নাম ও নাম্বার (বাংলা ইংরেজি উভয় ভাষায়)
সবশেষে পরবর্তী অপশনে ক্লিক করতে হবে।
৩য় ধাপ: আবেদনকারীর তথ্য
এই পর্যায়ে যিনি আবেদন করছেন তার তথ্য গুলো দিতে হবে। নিচের ছবির দিকে লক্ষ্য করুন, যদি টিক মার্ক করা ৩ জন ব্যতীত কেউ আবেদন করে। অর্থাৎ পিতা, মাতা ও নিজে ব্যতীত কেউ আবেদন করলে আবেদনকারীর তথ্য যেমন:
- জন্ম নিবন্ধন নাম্বার
- জাতীয় পরিচয় পত্রের নাম্বার
- জন্ম তারিখ
- আবেদনকারীর নাম ইত্যাদি তথ্য প্রদান করতে হবে।
আর যদি পিতা, মাতা বা নিজে আবেদন করে তবে এগুলো করতে হবে না, স্রেফ উক্ত সেকশনে ক্লিক করলেই তার তথ্য গ্রহণ করে নাম প্রদর্শীত হবে। বিষয়টি বুজতে নিচের ছবির দিকে লক্ষ্য করুন।
সবশেষে, সংযোজন নামক অপশনে ক্লিক করে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস গুলো (উপরের ধাপে কি ডকুমেন্টস লাগবে সেগুলোর আলোকে) সাবমিট করতে হবে। এরপর পরবর্তী নামক অপশনে ক্লিক করুন।
৪য় ধাপ: ওভারভিউ ও আবেদনপত্র ডাউনলোড
আবেদন প্রক্রিয়ার এই ধাপে এসে আপনি যে যে তথ্য দিয়েছে সেগুলো ওভারভিউ দেখাবে। তথ্য সব সঠিক আছে কি-না আরেকবার চেক করে নিবেন।
একদম নিচের দিকে এসে দেখবেন ইমেইল এড্রেস, মোবাইল নাম্বার দিতে বলছে সেগুলো সঠিকভাবে দিয়ে সাবমিট বাটনে ক্লিক করবেন।
৫ম ধাপ: অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন আবেদন পত্র ডাউনলোড
আবেদন প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শেষ, এবার আপনার আবেদনপত্রটির প্রিন্ট বের করে নিন। কেননা, যখন সনদ রেডি হয়ে যাবে এবং ইউনিয়ন পরিষদ / কাউন্সিল অফিসে চলে আসবে তখন এই আবেদনপত্রটির সাহায্যেই সেটি আনতে হবে।
জন্ম নিবন্ধন সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর
আবেদন করার কতদিন পর জন্ম নিবন্ধন সনদ পাওয়া যায়?
বর্তমানে আবেদন করার ১৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন হয়ে যায় এবং তা হয়ে গেলে আপনাকে নাম্বারে SMS এর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হবে।
একই ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধন দুইটি করা যায়?
না, সিস্টেম থেকেই ডুপ্লিকেট দেখাবে। তবে জন্ম নিবন্ধন যদি এনালগ ভার্সনের হয়ে থাকে আর সার্ভারে তথ্য সাবমিট করা না থাকে তাহলে করা পুনরায় করা যাবে।
পিতা মাতার জন্ম নিবন্ধন না থাকলে কিভাবে জন্ম নিবন্ধন আবেদন করবো?
নতুন আপডেট অনুযায়ী, ২০০১ সাল কিংবা তার পরে জন্ম নেয়া প্রতিটা শিশুর জন্ম নিবন্ধন করতে তার পিতা ও মাতার জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। তবে ২০০১ সালের পূর্বে জন্ম নিলে পিতা মাতার জন্ম নিবন্ধন নাম্বার প্রয়োজন হবে না।
চুড়ান্ত মন্তব্য
জন্মগ্রহণ করা প্রতিটা শিশুর জন্যই জন্মের নিবন্ধন করা একটি অধিকার। এই অধিকার প্রদানে শিশুর জন্মের পরপরেই জন্ম নিবন্ধন করে ফেলুন। বর্তমানে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন আবেদন করার নিয়ম খুব সহজ করা হয়েছে তাই কোনো প্রকার ভোগান্তি ছাড়াই জন্ম নিবন্ধন করে ফেলতে পারবেন। এই আর্টিকেলে উক্ত বিষয়ে কি কি করা উচিৎ সে বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়েছে।
Leave a comment